আজ ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করল সরকার, প্রজ্ঞাপন জারি


অনলাইন ডেস্ক

নির্বাহী আদেশে অবশেষে নিষিদ্ধ করা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে। যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দলটিকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একই অপরাধে তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সরকারের নির্বাহী আদেশে বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এর আগে (মঙ্গলবার) বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার কথা জানান। তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে জামায়াত-শিবির একটি শক্তিশালী সংগঠন, এ মুহূর্তে তাদের নিষিদ্ধ করা হলে সরকার পরবর্তী সময়ে কোনো ঝামেলায় পড়বে কি না-যুগান্তরের এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি দীর্ঘদিনের। যুদ্ধাপরাধ ছাড়াও দলটি মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের পেছনেও এ দলটি। সর্বশেষ ১৬ জুলাই থেকে দেশে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের ওপর ভর করে যে সহিংসতা চালানো হয়েছে; এর পেছনেও জামায়াত-শিবির সরাসরি জড়িত।

অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আরও বলেন, যারা কোটা আন্দোলন করেছে, তারা কিন্তু বলেছে এ সহিংসতার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সেই ক্ষেত্রে আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত আছে, জামায়াত-শিবির-বিএনপি-ছাত্রদল যারা জঙ্গি, তারাই এটা করেছে।

জামায়ত-শিবির স্বাধীনতাবিরোধী, ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০০১ সালে জামায়াতের আমির যখন মন্ত্রী, তখন বাংলাভাইয়ের উত্থান। জামায়াতের আমির তখন বলেন, বাংলাভাই বলে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। এ বাংলাভাই মানুষ মেরে ওপরের দিকে পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত।

এবারের বিগত কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তিনজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। তাদের দুজনের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে। দেশে যত জঙ্গি রয়েছে, সেগুলোর শেকড় টানলে দেখা যায়, সেগুলোর পেছনে জামায়ত-শিবির রয়েছে। যারা ২০০৫ সালে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা করেছে, তাদের পেছনেও ছিল জামায়াত-শিবির।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার (২৪ জুলাই) গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সভায় চলমান ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে দেশব্যাপী সংঘাত-সহিংসতায় সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন নেতারা। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানান।

সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠনের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে; তবে শর্ত থাকে যে কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি-ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থি হয়।’

উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টিসহ ২৫টি সংগঠনের নেতারা এ নিবন্ধন দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করেন।

তারা জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের আরজি জানান। ওই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। ৬ সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

রুল জারির পর একই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুবার জামায়াত তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।

২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হয়। পরে জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ‘অবৈধ’ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।

তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।

২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল (লিভ টু আপিল) আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এর ফলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের রায় বহাল থেকে যায়।

পাশাপাশি ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ৫৫টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল ১৬৯ জন। বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া এই আসামিদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী। যুদ্ধাপরাধী বিচারের ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করে তখন। একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিচারের পর দাবি ওঠে দল হিসাবে জামায়াত ইসলামীর বিচার করার।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর